Adi Ganga- The sacred river bangla
story-icon-adi-ganga

আদি গঙ্গা- কলকাতার অবিচ্ছেদ্য জলজ ঐতিহ্য

কলকাতার জলীয় ভূগঠনের উদীয়মান কাহিনি
পরিচালনা
দেবীকা ব্যানার্জি এবং শ্রেয়সী ভট্টাচার্য

আদি গঙ্গা হল হুগলি নদীর একটি পুরনো চ্যানেল। এটি কলকাতার দক্ষিণ দিক পেরিয়ে বঙ্গোপসাগরের দিকে প্রবাহিত হয়েছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মেজর উইলিয়াম টলি ১৮শতকে এটি খনন করেন শহরে নৌচলাচল এবং পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য। এটি সেসময়ে ‘টলির নালা’ নামে পরিচিত ছিল। এই প্রবাহটি মধ্যযুগীয় কেন্দ্রস্থলে থাকা সত্ত্বেও, ১৮শতকে মেজর উইলিয়াম টলি যখন খালটি খনন শুরু করেন তখন নদীটি আবার জনপ্রিয়তায় পায়। আদিগঙ্গা বর্তমানে নগর উন্নয়ন এবং শহরের বেড়ে ওঠা দূষণের ভারে জর্জরিত।  এমনটাই হয়েছে বর্তমানে বেশিরভাগ দক্ষিণ এশিয়ার নদীগুলির ক্ষেত্রে। আদি গঙ্গা এই কাহিনিটি নদীর বিবর্তন, রূপান্তর ও তার তীরবর্তী নানা অর্থ-সামাজিক-পরিবেশগত সমাবেশ চিহ্নিত করে,যা নদীর পুনর্জীবনের জন্যে প্রয়োজনীয়।

সময়ের প্রবাহে নদী: কীভাবে ন্যাভিগেশনাল লিঙ্ক শহর জুড়ে ঘুরে বেড়িয়েছে

১৮৬০এর দশকে কালীঘাটের কাছে আদি গঙ্গা। (উৎস: স্যামুয়েল বোর্ন, ১৮৬০, ১৯শতকের ভ্রমণ ফটোগ্রাফি)

তৎকালীন কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পথ ছিল এই আদি গঙ্গার নৌ-পথ। উইলিয়াম টলি যখন গঙ্গার পুরনো বেডটিকে খনন করেন, তখন এই পথটি বাণিজ্যের জন্য সুন্দরবনের সাথে যুক্ত হয়েছিল, যার ফলে নদীর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায় এবং তার তীরে জনবসতি বৃদ্ধি পায়।

উদীয়মান মহানগরে একটি গুরুত্বপূর্ণ নৌ-প্রবাহের পাশাপাশি, আদি গঙ্গা একটি পবিত্র নদী (হিন্দু ধর্ম অনুসারে)। বাংলার মধ্যযুগীয় সাহিত্যে নদীটির পবিত্রতার কথা আছে।  ঔপনিবেশিক বিবরনে নাগরিকদের মধ্যে এই নদীর প্রতি শ্রদ্ধার সাক্ষ্য পাওয়া যায়। আদিগঙ্গার তীরে নির্মিত দেবী কালীর মন্দির সহ কালীঘাট স্থানটি হিন্দুদের জন্য একটি পবিত্রতম তীর্থস্থান। এটি নদীর সাথে সংযুক্ত হয়ে এক ঐতিহাসিক ও পবিত্রতার চিত্রকে তুলে ধরে।

১৯৪৫ সালে কালীঘাটের কাছে আদিগঙ্গা।(সূত্র: ফ্রাঙ্ক বন্ড (উইকিমিডিয়া কমন্স))

নদী ও লোকসংস্কৃতি

মনসামঙ্গল পটচিত্রের মধ্যে কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে আদি গঙ্গা Jean-Pierre Dalbéra, 2007; Extrait de Manasa Mangal de Mayna Chitrakar (Naya / Bengale; posted in Flickr

নদীকে কেন্দ্র করে একটি ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি থাকা সত্ত্বেও, আদিগঙ্গা বা ‘টলির নালা’ নগরায়নের ভার এড়াতে পারেনি। সেই ঔপনিবেশিক আমল বা উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগেও রেলপথ ও সড়কপথের ক্রমবর্ধমান গুরুত্বের সঙ্গে তাল রাখতে পারেনি আদি গঙ্গা, এবং তার রক্ষণাবেক্ষণের প্রতি আগ্রহ হ্রাস পায় মানুষের মধ্যে। যার ফলশ্রুতি বর্তমান অবস্থায়, আদিগঙ্গা একটি নোংরা ও দূষিত ক্ষেত্র হিসেবে প্রসারিত হয়ে চলেছে। দুর্ভাগ্যবশত,  রাষ্ট্র ও জনগণ উভয়ই একে নিছক আবর্জনা ডাম্পিং সাইট হিসাবে বিবেচনা করছে।

সাম্প্রতিক দুর্ভাগ্য

নদীকে কেন্দ্র করে একটি ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি থাকা সত্ত্বেও, আদিগঙ্গা বা ‘টলির নালা’ নগরায়নের ভার এড়াতে পারেনি। সেই ঔপনিবেশিক আমল বা উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগেও রেলপথ ও সড়কপথের ক্রমবর্ধমান গুরুত্বের সঙ্গে তাল রাখতে পারেনি আদি গঙ্গা, এবং তার রক্ষণাবেক্ষণের প্রতি আগ্রহ হ্রাস পায় মানুষের মধ্যে। যার ফলশ্রুতি বর্তমান অবস্থায়, আদিগঙ্গা একটি নোংরা ও দূষিত ক্ষেত্র হিসেবে প্রসারিত হয়ে চলেছে। দুর্ভাগ্যবশত,  রাষ্ট্র ও জনগণ উভয়ই একে নিছক আবর্জনা ডাম্পিং সাইট হিসাবে বিবেচনা করছে।

কালীঘাটের কাছে অত্যন্ত দূষিত নদীর খাত

স্তম্ভ নির্মাণ ও লুটতরাজ

আদি গঙ্গা একুশ শতকের গোড়ার দিকে তার দৈর্ঘ্যের মধ্যেই মেট্রো রেলপথ নির্মাণের জন্যে প্রবল লড়াইয়ের মুখোমুখি হয়েছিল। পরিবেশবাদী এবং কর্মীদের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, রাজ্য ও বিচার বিভাগ টালিগঞ্জ থেকে গড়িয়ার মধ্যে নদীর প্রবাহে ৩০০টি স্তম্ভ খননের অনুমোদন দিয়েছিলেন। এই বিষয়ে চূড়ান্ত হস্তক্ষেপের মাধ্যমে, আদিগঙ্গাকে আরও অধঃপতনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যা। এটিকে নিছক নর্দমায় পরিণত করেছে।

আদি গঙ্গার ওপর দিয়ে মেট্রো রেলের করিডর, টালি নামা, গড়িয়া

বিস্মৃত নদী

আদি গঙ্গার নিত্য পরিষ্কার কাজ

আদিগঙ্গা – টলি’র নালা বর্তমানে একটি পরিতক্ত নর্দমায় পরিণত হয়েছে। কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন স্থানীয় যুবকদের ম্যানুয়ালি নদী পরিষ্কার করার জন্য নিযুক্ত করে। অজৈব বর্জ্য তোলার জন্য জাল ও ছোট নৌকা ব্যবহার করা হয়। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে সচেতনতার অভাবে, এটি নগণ্য বলে মনে হচ্ছে। লোকে নিজেদের বাড়ির ডাম্পিং গ্রাউন্ড হিসাবে বিবেচনা করে চ্যানেলটির শ্বাসরোধ করে চলেছে।

নদী এবং মানুষের মধ্যে সম্পর্ক

নদীর গল্প শুধু তার ভূতাত্ত্বিক অবস্থাতেই সীমাবদ্ধ নেই। বহু শতাব্দী ধরে তার তীরে বসবাসকারী পরিবারগুলি এই ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী। নদী পাল্টেছে, তাই বাসিন্দাদের জীবনও বদলেছে। হাজার হাজার মানুষ, বেশিরভাগই সমাজের সুবিধা বঞ্চিত অংশ থেকে আসা, যারা রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে বাঁচতে এবং শহরে জীবিকা খুঁজতে নদীর তীরে আশ্রয় নিয়েছিল- তাদেরকেই নদীর অবনতিময় পরিস্থিতির জন্য দায়ী করা হয়।

আদি গঙ্গার পাসে বসতি

নদী থেকে গল্প বের হয়

নদী তাদের কাছে কি…

বিশেষ করে মেট্রো নির্মাণের সময়ে রাজ্য সরকার কর্তৃক তীরবর্তী বাসিন্দাদের নির্মমভাবে উচ্ছেদ করা সত্ত্বেও, অনেকে আবার তীরে বসতি স্থাপন করেছে পরে। এই বাসিন্দারা যাদের পরিবার কয়েক শতাব্দী ধরে এখানে বসবাস করছে, তারা আদিগঙ্গার মাহাত্ম্য এবং পরবর্তীকালের পতনের গল্পগুলি, যা শুনে এসেছেন ছোটবেলা থেকে, এখন ভাগ করে নিচ্ছেন নতুন প্রজন্মের সাথে।

নদী এবং এর পবিত্রতা

প্রচুর পরিমাণে ময়লা এবং পয়ঃনিষ্কাশন সঞ্চিত হওয়া সত্ত্বেও, ভক্তজনেরা দূষিত নদীতে তাদের ধর্মাচার করতে থাকে। কারণ, তারা বিশ্বাস করে এতে তাদের আত্মা শুদ্ধ হতে পারে ও নশ্বর পাপ থেকে মুক্ত পাওয়া সম্ভব। তাদের জন্য নদীর ঐতিহ্য এবং পবিত্রতা সব আবর্জনার ঊর্ধ্বে এবং এই ময়লা হয়ে ওঠে ‘স্বস্থানের বাইরের’।

আদি গঙ্গার ঘাট, কালি মন্দির, কালীঘাট

নদীর বিভিন্ন মেজাজ

আদিগঙ্গার তীরে মানুষের জীবন কখনোই অন্ধকারাচ্ছন্ন নয়। সমাজের নানা শ্রেণি ও পেশার মানুষ যারা কয়েক দশক এমনকি কয়েক শতাব্দী ধরে এখানে বসবাস করেছেন তারা তাদের জীবনকে মানিয়ে নিয়েছেন এই পরিবর্তনশীল নদীকে ঘিরে। বয়স্করা ঘাটে বসে চায়ের কাপ ভাগাভাগি করেন, বাচ্চাদের খেলা দেখেন- নদীতে দুর্গন্ধ ও ময়লার স্তূপ থাকা সত্ত্বেও।

নদীর পাড় শিশুদের খেলার জায়গা
কলকাতার বাইরে আদি গঙ্গার প্রবাহ

শহরের প্রান্তে পৌঁছে এই নদীটি, তুলনামূলকভাবে কম শহুরে হস্তক্ষেপের মধ্যে দিয়ে প্রায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে এবং এটি একটি পরিষ্কার এবং স্বাস্থ্যকর অবস্থায় বঙ্গোপসাগরের দিকে যাত্রা করেছে। যদিও আদিগঙ্গাকে নগরীকরণ থেকে মুক্ত  করা সম্ভব নয়, তবে স্থানীয় সম্প্রদায় ও রাজ্য সরকারের কার্যকলাপ নদী ও তার বাসিন্দাদের ভবিষ্যতের জন্য পরিবর্তনশীল ফলাফল আনতে পারে।

নদীর দৃশ্যায়ন

আদিগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা একাধিক গল্পের উল্লেখের মধ্যে দিয়ে নদীর ধারাবাহিকতাকে নির্ণয় করা যায় না। নদীর এই রেখাচিত্র তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নদীর এই বৈচিত্র্যময় বিবর্তনগুলিকে ধরার চেষ্টা করে। এই ক্ষেত্রে পুরানো নদীটি বাম দিকে আঁকা হয়েছে ও ডানদিকে নদীর বর্তমান অবস্থা দেখানো হয়েছে। আদিগঙ্গা  একটি শক্তিশালী নদী- যেটি দিয়ে নিম্ন-গাঙ্গেয় বদ্বীপে জাহাজ চলাচল করেছে ও অসংখ্য জীবন কয়েক দশকের দূষণ ও অবহেলার কারণে দমবন্ধকর অবস্থার মধ্যে রয়ে গেছে।

আদি থেকে শেষ- আদিগঙ্গা সর্বদা শহরের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তার অবহেলাতেও তা ফিনিক্সের মতো বয়ে চলেছে চিরপ্রবাহে।

আদি গঙ্গা পাড়ের মানুষজনের সঙ্গে মিলেমিশে রয়েছে- তারই এক মেলবন্ধন