লালদিঘি- কলকাতায় ৫.৭একর স্থান জুড়ে আয়তাকার জলাশয় এটি। লালদিঘি বিবিডিবাগ অঞ্চলের একটি অন্যতম স্থান। এলাকাটি কলকাতার ঐতিহাসিক ‘ব্লু-সেন্টার’ নয়, এটি এখন তিন শতাব্দীরও বেশি ধরে শহরের প্রশাসনিক কেন্দ্রস্থল হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
লালদিঘিকে ঘিরে বেশ কিছু ঐতিহাসিক ভবন রয়েছে। উত্তরে রাইটার্স বিল্ডিং (রাজ্য সরকারের সচিবালয়), পশ্চিমে জেনারেল পোস্ট অফিস (জিপিও) (যা পুরাতন দুর্গের ফুটপ্রিন্টে দাঁড়িয়ে), দক্ষিণে স্ট্যান্ডার্ড লাইফ অ্যাসুরেন্স বিল্ডিং, ডেড লেটার অফিস ও কারেন্সি বিল্ডিং আর পূর্বে বিশিষ্ট সৌধ রয়েছে। যেমন, রয়্যাল এক্সচেঞ্জ (রবার্ট ক্লাইভের প্রাক্তন বাসভবন, বর্তমানে বেঙ্গল চেম্বার অফ কমার্সের আবাসস্থল), টাউন হল, হাইকোর্ট, গভর্নর হাউস এবং সেন্ট জন’স চার্চও কাছাকাছি রয়েছে।
অ্যাকশন রিসার্চ ইন কনজারভেশন অফ হেরিটেজ (ARCH) এবং ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ট্রাস্ট ফর আর্টস অ্যান্ড কালচারাল হেরিটেজ (INTACH) এর উদ্যোগে, ২৪শে সেপ্টেম্বর ২০০৩সালে ওয়ার্ল্ড মনুমেন্ট ফান্ড দ্বারা এই স্কোয়ারটিকে ‘বিশ্বের ১০০টি সবচেয়ে বিপন্ন স্থান’এর মধ্যে একটি হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। লালদিঘির চারদিকে সবুজ সবুজে ভরে আছে। লালদিঘি ধীর কিন্তু দৃঢ়ভাবে উত্তর, পূর্ব এবং দক্ষিণে তার সবুজ খোলা জায়গাগুলিকে বজায় রেখেছিল। কিন্তু শহুরে সুবিধার কাছে হার মানতে হয়েছে তাকে। সেখানে এসেছে কংক্রিটের উপস্থিতি। জেনারেল পোস্ট অফিসের দিকে পশ্চিমের অংশটি এখন একমাত্র বিস্তৃত উন্মুক্ত সবুজ হিসেবে অবশিষ্ট রয়েছে।
শুরু
১৬৯০সালে জোব চার্নক যেখানে তার ব্যবসায়িক ক্ষেত্র স্থাপন করেছিলেন এবং যেখানে পুরানো ফোর্ট উইলিয়ামটি পরে নির্মিত হয়েছিল (১৬৯৮তে শুরু হয়েছিল এবং ১৭০৬তে শেষ হয়েছিল) তার ঠিক পাশেই, লালদিঘি ব্রিটিশ ব্যবসায়িক বন্দোবস্তের ‘ব্লু-সেন্টার’ হিসাবে কাজ করেছিল। যা তখন পরিচিত ছিল ‘হোয়াইট টাউন’ নামে। ১৮শতকে লালদিঘিকে ‘শহরের মাঝখানে’ হিসেবে ধরা হত।
লালদিঘি নামকরণের উৎস
বাংলা ভাষায় লালদিঘির অর্থ ‘লাল ট্যাঙ্ক’। এই ধরনের একটি নাম কিভাবে উদ্ভূত হয়েছিল সে সম্পর্কে তিনটি মতবাদ রয়েছে:
- স্থানীয় জমিদার সাবর্ণ রায় চৌধুরীর পরিবারের শ্যাম রায়ের মন্দিরের কাছে খেলা ‘হোলি’ বা ‘দোল’ উৎসবের সময় জল লাল হয়ে যায়।
- ইন্ডিয়া কোম্পানির লাল রঙের পুরানো দুর্গটি জলে প্রতিফলিত হয়েছিল, তাই এই নাম করা হয়েছে।
- ‘ডিহি কালিকাতা’র লালচাঁদ বসাক নামে এক ব্যবসায়ী পুকুরটি খনন করেন এবং তার নামানুসারে এই জলাশয়টি লালদিঘি নামে পরিচিত হয়।
অনেক নাম ও অনেক ব্যবহার
প্রথমে ব্রিটিশদের দ্বারা ‘গ্রিন বিফোর দ্য ফোর্ট’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছিল, এর নামকরণ করা হয়েছিল ‘দ্য পার্ক’ এবং ‘দি গ্রেট ট্যাঙ্ক’ নামে। তারপরে ‘ট্যাঙ্ক স্কোয়ার’। তবে, শেষ পর্যন্ত গভর্নর জেনারেল (১৮৪৭-১৮৫৬) লর্ড ডালহৌসি (১৮১২-১৮৬০) স্মরণে ১৮৬৫তে নামকরণ হয়েছিল ‘ডালহৌসি স্কোয়ার’। ১৯৬০-এর দশকে, স্কোয়ারটির নাম পরিবর্তন করে বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগ বা সংক্ষেপে ‘বিবিদিবাগ’ রাখা হয়েছিল। পৌরসভার জল সরবরাহ ব্যবস্থা প্রবর্তন না হওয়া পর্যন্ত পার্ক এবং ট্যাঙ্কটি একসাথে কোম্পানিকে গাছপালা ও মাছের জন্যে জল সরবরাহ করত। পাশাপাশি এটি পানীয় জলের প্রধান উৎস ছিল। লালদিঘির মাঠ ছিল সেই সময়ের বিনোদনের কেন্দ্রস্থল, এখানে ব্রিটিশরা সন্ধ্যায় হাঁটাহাঁটি করতেন, গঙ্গার হাওয়া উপভোগ করতেন এবং বন্য পাখী শিকার করতেন।
লালদীঘি ১৮-২0 শতকের গোড়ার দিকে
লালদিঘি বর্তমান সময়ে
ইতিহাসের একটি ব্ল্যাক হোল
লালদিঘির যুদ্ধ
‘পার্ক’-এর শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ১৭৫৬সালে একটি যুদ্ধের হিংসাত্মক অবস্থার মধ্যে দিয়ে পরিবর্তিত হয়। সেসময়ে মুর্শিদাবাদের নবাবের বাহিনী শহরে তাণ্ডব চালিয়ে ১৭৫৬সালের ২০ জুন কলকাতা দখল করে। সেন্ট অ্যানের গির্জা (নির্মিত হয়েছিল ১৭০৯), যেখানে রাইটার্স বিল্ডিং এখন দাঁড়িয়ে আছে সেখানে পুরানো ফোর্ট উইলিয়ামের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই যুদ্ধটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ‘ব্ল্যাক হোল ট্র্যাজেডি’নামে পরিচিত।
১৭৫৭সালে ভাগ্যের পরিবর্তনে বাংলার শেষ নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলাকে পরাজিত করে মুর্শিদাবাদের পলাশীর যুদ্ধে লর্ড ক্লাইভ কলকাতা পুনরুদ্ধার করেন। পুরানো দুর্গ আবার ১৭৫৮সালে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
পরবর্তী প্রায় দুই শতাব্দীতে কলকাতা ‘প্রাসাদ নগরী’ হিসাবে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করে, যা বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠানের দ্বারা চিহ্নিত করা যায়। যেমন এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল (১৭৮৪), গভর্নর হাউস (১৮০৩), ইম্পেরিয়াল মিউজিয়াম যার পরবর্তী নাম ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম (১৮১৪), এগ্রিকালচার হর্টিকালচারাল সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া (১৮২০), জেনারেল পোস্ট অফিস (১৮৬৮), কেন্দ্রীয় টেলিগ্রাফ অফিস (১৮৭৬), ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল (১৯২১)। শহরের প্রাকৃতিক সীমানা এসবের মধ্যে দিয়ে বহুগুণে প্রসারিত হয়েছে। লালদিঘি ও তার আশেপাশের অঞ্চল যদিও তার গঠনের দিক থেকে বেশিরভাগই অপরিবর্তিত ছিল।
১৭৮৪-৮৫, ১৮২৫-৩২ এবং ১৮৫৫ সালের তিনটি মানচিত্রের তুলনাতে ট্যাঙ্ক স্কোয়ারের উত্তর-পূর্ব কোণার একটি বিবর্তন প্রতিফলিত হয়। প্রথমটিতে ওল্ড কোর্ট হাউস (বা কুটচেরি) দেখা গেলেও, দ্বিতীয় মানচিত্রে এটি সেন্ট অ্যান্ড্রু’স চার্চ (১৮১৮) দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে এবং শেষ আলোকচিত্রটি লালদিঘির উত্তরের দিকে আধিপত্য বিস্তারকারী চার্চের চূড়াকেই দৃশ্যমান করেছে।
লালদীঘি পরিবেশের বিবর্তন দেখানো জরিপ মানচিত্র
কলকাতার ইন্টারেক্টিভ মানচিত্র
মিশন : অ(সম্ভব) ১৯৩০
সাহসী ত্রয়ী
লালদিঘির যুদ্ধের দেড় থেকে দুই শতাব্দীর পরে এই ময়দানে আরও একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অংশ হিসাবে এটি একটি ‘বিপ্লবী পদক্ষেপ’। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার তীব্র আকাঙ্ক্ষায়, তিনজন বাঙালি সাহসী-হৃদয় তাদের কৈশোরেই (কুড়ির দশকের শুরুতে) কারাগারে স্বাধীনতাসংগ্রামীদের প্রতি অমানবিক নির্যাতনের প্রতিশোধ নেওয়ার সংকল্প করেছিলেন।
বিনয় বসু (২২), বাদল গুপ্ত (১৮) এবং দীনেশ গুপ্ত (১৯)। এই বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের সদস্যরা ১৯৩০সালের ৪ ডিসেম্বর পূর্বতন সেক্রেটারিয়েটে (বর্তমানে রাইটার্স বিল্ডিং) প্রবেশ করেন। প্রবেশাধিকার পাওয়ার জন্য তারা বেশবদল করে পশ্চিমা পোশাক পরেছিলেন। সেখানে গিয়ে বিনয়, বাদল এবং দীনেশ কুখ্যাত ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল এন.এস.সিম্পসনকে গুলি করে হত্যা করে। এতেই তাদের মিশন পূর্ণ হয়। এই মিশনের পরেই অনিবার্যভাবে বীর ত্রয়ী শহীদ হয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর লালদীঘির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছিল বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগ (যেখানে ‘বাগ’ শব্দটির মানে বাগান/পার্ক) যা সংক্ষেপে বিবিদি বাগ। স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁদের সর্বোচ্চ ত্যাগ ও অবদানকে সম্মান জানাতে এই নামকরণ হয়েছিল।
স্কাইলাইন পরিবর্তন
কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের ১৯১০সালের জরিপ মানচিত্র লালদিঘির কাছে দুটি কাঠামোকে দেখায় যা আজ বিদ্যমান নেই:
- হলওয়েল স্মৃতিস্তম্ভ (কালো বিন্দু দ্বারা পরিবেষ্টিত মানচিত্রে) ১৭৬০সালে জি.হলওয়েল দ্বারা এটি নির্মিত হয়েছিল। 1940 সালে প্রধানত নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর প্রচেষ্টার এটি সেন্ট জনস্ গির্জার মাঠে সরানো হয়েছিল।
- ডালহৌসি ইনস্টিটিউট (মানচিত্রে লাল বিন্দু দ্বারা চিহ্নিত), ১৮৬৫সালে নির্মিত কিন্তু ১৯৫০সালে টেলিফোন ভবন দ্বারা এটি প্রতিস্থাপিত হয়েছে।
একটি নীল-সবুজ স্থান, একটি সর্বজনীন স্থান
লালদিঘির পুনর্জীবন (২০১২-২০১৩)
২০১১ সালে নবনির্বাচিত রাজ্য সরকার রাইটার্স বিল্ডিং পুনরুদ্ধার করার এবং লালদিঘি ময়দানকে (অর্থাৎ পশ্চিম দিকের অংশ) পুনরুজ্জীবিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেটি গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছিল। স্থাপত্যের ঐতিহাসিকতা এবং অঞ্চলটির পরিবেশগত উন্নতির যথাযথ বিবেচনার সাথে, সেখানে জনসাধারণের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে স্থানটিতে বৃক্ষরোপণের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। পূর্ববর্তী কলকাতার এই ঐতিহাসিক স্থানটির স্মৃতি বজায় রাখতে এমত উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দিঘির আশেপাশের বেশিরভাগ ভূমির ব্যবহার থাকায়, লালদিঘির আশেপাশের এলাকাগুলি সারা দিন প্রাণবন্ত থাকে।
তবে রাতে শান্ত ও জনশূন্য হয়ে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গ পিডাব্লুডি, কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন, ফিশারিজ ডিপার্টমেন্ট, ক্যালকাটা ট্রাম কোম্পানি ইত্যাদি দিঘির আশেপাশে পরিষেবাকে প্রসারিত করেছে। চাকুরিমুখী ও পথচারীরা এই সতেজ সবুজ-নীল শূন্যতার মাঝে বিরতি নিতে আসে। তারা মাঝে মাঝে দিঘির কেন্দ্রে স্থাপিত জেট ফোয়ারাটির ঊর্ধ্বগামী গতি দেখে। গাছের ছাউনি, সুগন্ধী ফুল, ঠাণ্ডা বাতাস, রূপালি জলে আকাশের প্রতিচ্ছবি আর বিস্তৃত খোলামেলা শান্ত মননশীল পরিবেশকে উপভোগ করে। এই প্রশান্তির আড়ালে লুকিয়ে আছে তিন শতাব্দীর শহুরে ইতিহাস। কেবল সেই মানুষদের কাছেই সে ইতিহাস প্রকাশ করে যারা লালদিঘির মৃদুস্বরের কথা শুনতে চায়।
২০১২-১৩ সালের লালদীঘি পরিবেশের আগে-পরের ছবি
আগে
পরে
বিশেষ নজরে লালদিঘি
কোভিড-১৯ মহামারীর প্রাদুর্ভাবের আগে পর্যন্ত লালদিঘি জীবনীশক্তিতে পরিপূর্ণ ছিল। তারপর থেকে তিন বছর চুপচাপ। লালদিঘি জনজীবন ও পাশাপাশি পৌর শাসন এই উভয় ক্ষেত্রেই পরিবর্তিত পরিণতি থেকে এখনও পুনরুদ্ধার করতে পারেনি, যা করতে এক দশক লাগতে পারে।
কলকাতার এই ‘ব্লু সেন্টার’এর পাশ দিয়ে পূর্ব-পশ্চিম মেট্রো যাওয়ার কারণে, আমরা কেবল আশা করতে পারি যে মেট্রো রেল তার বাড়তি স্টপেজ লালদিঘিতে দিলে, এটি তার অতীত গৌরব ফিরে পাবে।
তথ্যসূত্র
- Amrit Mahotsav, Govt. of India, freedom-movement-detail. (accessed on 10.04.2023)
- Amrit Mahotsav, Govt. of India, unsung-heroes-detail.htm (accessed on 10.04.2023)
- ARCH & INTACH, (2005), Proceedings of the Workshop on ‘Conserving, improving and managing the historic city centre of Dalhousie Square, Kolkata’.
- Bardhan, S., (2011), Detailed Project Report on Laldighi for Kolkata Municipal Corporation.
- Busteed, H.E., (1908), Echoes front Old Calcutta: 1908 (4th edition).
- Chattopadhyay, M., (2013), Paschim Banger Porikalpita Nagarayan.
- Kundu Anil Kumar & Nag Prithvish, (1996), Atlas of the City of Calcutta and its environs, National Atlas & Thematic Mapping Organisation (NATMO).
- Netaji Research Bureau (accessed on 06.04.2023) Netaji Research Bureau
- Mukhopadhyay A., https://puronokolkata.com/2016/02/15/lal-dighi-lal-bagh-calcutta-1690/ (accessed on 10.04.2023)
- Ray M., Old Mirrors: Traditional Ponds of Kolkata, KMC, 2010.
- tuckdbpostcards (accessed on 06.04.2023)